দশ বছর পর দেখা হল বইমেলার মাঠে। ভেবেছিলাম এগিয়ে গিয়ে বলি “চিনতে পারছেন”? চেনবার কথাও নয় যদিও। উনি একজন বিখ্যাত কবি। আর আমি একজন যার বই-টই পড়ার ঝোঁক আছে, দু'চারজন কবি-সাহিত্যিকের নাম জানি। বইমেলায় বেড়াতে
গেছিলাম। আগে যেতাম বই মাখতে। আগে মানে দশ বছর আগে। তখন আমার চোখ দুটোও অন্যরকম
ছিলো। দশ বছরে কবির বয়সও দশটা বছর বেড়ে
গেছে। কবিকে অনেক বেশী লোক এখন চেনে, কবিরও অনেক চেনাশুনো বেড়েছে। দশ বছর আগে মঞ্চে
দাঁড়িয়ে বিষণ্ণ সুরে নিজের লেখা পড়তেন, ইদানিং তিনিই জনসভায় দাঁড়িয়ে দিন
পালটে দেবার ডাক দেন। রাজনৈতিক দলের পতাকায় ঢেকে গেছে সেদিনের সেই ভোরের
কুয়াশা, সকালবেলার আলো, একলা দুপুরগুলো, রোদ পড়ে আসা বিকেল, বিষাদ মাখা সন্ধে আর
একলা হতে চাওয়া রাতগুলো। দশ বছরে বোধহয় পালটে গেছে
কবির চোখদুটোও।
বাইরে মৌসুমী প্রকাশনীর স্টলটার দিকে অনেক জোড়া কৌতূহলী চোখগুলো কাটিয়ে কাটিয়ে এগোই। আনন্দ পাবলিশার্সের বিরাট স্টলটা কোথায় করেছে কে জানে। এগোতে থাকি। দু'দিকে সার সার একশো ভুতের গল্প, সেরা হাসির গল্প, বিমল মিত্রর পাঁচটি উপন্যাস একত্রে,ছোটদের ছড়া ও ছবি... এই তো দেজ পাবলিশিং। ভেতরে খুব ভিড়। ভিড়ের পাশ দিয়ে এগোতে থাকি। টাটা ম্যাকগ্রহিলের স্টলটার জানলায় কম্পিউটারের বই সারি সারি। উল্টোদিকে নিকারাগুয়ার প্যাভিলিয়নের পেছন দিকটা। এবারের বইমেলার থিম। আরে ওই তো আনন্দ পাবলিশার্স! হঠাৎ কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে পাওয়ার মত পুলকিত হই। স্টলের বাইরে দীর্ঘ লাইন ঢোকার অপেক্ষায়। অনেকেরই মুখটা চেনা চেনা লাগে। দার্জিলিঙে টাইগার হিলে বেড়াতে গিয়ে, প্যারিসে আইফেল টাওয়ারের নীচে, পুরীর সি-বিচে এদেরই অনেকের সঙ্গে মনে হয় দেখা হয়েছিল। নাঃ আলাপ নেই আমার কারোর সঙ্গে। যাই হোক, বইমেলায় এসে আনন্দ আর দে'জের স্টলটায় একবার ঢুকব না,তাই আবার হয় নাকি! কিন্তু আজ না হাতে একদম সময় নেই। বউকে বলি- আরেকদিন আসতে হবে বুঝলে।
পায়ে পায়ে এগোই। একদিকে মস্ত ছাউনির নীচে ইত্যাদিদের মেলা। ইত্যাদি মানে লিটল ম্যাগাজিনের স্টলপুঞ্জ। সারি সারি টেবিল। রাশি রাশি রংবেরঙের পত্রিকা। ঠিক সবজি বাজারের মতন। জিনস-টিশার্ট-উলোঝুলো চুল-দাড়িতে ঘেরা ভীষণ সিরিয়াস মুখগুলো। কাঁধে ঝোলা ব্যাগ। এরা সবাই লেখে। রাজনৈতিক দল করার মত 'লিটল ম্যাগ' করে। যত্ন করে লেখে কবিতা গল্প প্রবন্ধ। নিজেরাই ছাপায়। নিজেদের চেনাশোনার বৃত্তের মানুষের মধ্যেই বিলি হয় বিক্রি হয় কয়েকটা বই। কয়েকজনের লেখা গল্প-কবিতা মাঝেমাঝে বড় ম্যাগাজিনে বেরোয়। এখানে সবাই সবাইকে চেনে। আমি কারোকেই চিনি না। আমাকেও কেউ চেনে না। চিনবার কথাও নয়। অনেক বছর পরে কলেজের কমনরুমে ঢুকে পড়ার মত করে অস্বস্তিতে পড়ি। একটা দল এক্ষুণি বেরিয়ে আসছে জটলার মধ্য থেকে। দলের মধ্যমণি সাদা পাঞ্জাবি চশমা পরা মানুষটির মুখটা চেনা চেনা। টিভিতে দেখেছি। বিখ্যাত সাহিত্যিক। ওঁর লেখা গল্প-উপন্যাস পড়ি কাগজে-ম্যাগাজিনে-শারদীয়ায়। সঙ্গীসাথীদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে আমার পাশ দিয়ে তিনি এগিয়ে যাচ্ছেন। জানুয়ারি শেষের ঠান্ডা হাওয়ায় আমার শরীরটা একটু শীত-শীত করে ওঠে। বিখ্যাত সাহিত্যিকের পেছনে-পাশে একঝাঁক নারী-পুরুষ। মাঝে মাঝে থেমে দ্রুত সই দিচ্ছেন বাড়িয়ে দেওয়া খাতায়। মাথা নেড়ে কথা বলছেন তিনি, মুখে হালকা হাসি। অদূরে মাঠের মধ্যে ঘাসের ওপর খবরের কাগজ পেতে বসেছে জনা তিনেক। না। আড়াইজন। বাচ্চাটা মুঠো করে ঘাস ছিঁড়ছে। তার মা ব্যাগ হাতড়ে চিরুণিটা বের করে চুলে বসাল। বড্ড ধুলো। পাশে দুটো চকচকে প্লাস্টিকের প্যাকেট। সদ্য কেনা বই। বাচ্চাটার বাবার হাতে বইমেলার একটা ম্যাপ। ম্যাপটা মাটিতে পেতে দেখছে মন দিয়ে। আর কোন কোন স্টলে ঘোরা বাকি আছে। পুজোয় ঠাকুর দেখার মত করে স্টলগুলো না ঘুরলে আর বইমেলায় আসা কেন। মুখ তুলে তারা এখন অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে এই ভীড়টার দিকে। ইউবিআই অডিটোরিয়ামের দিক থেকে মাইকে ঘোষণা করা হচ্ছে- আজ কার যেন একটা নতুন বই প্রকাশিত হবে। তারপর কোনও একটা সাহিত্য পুরষ্কার প্রদান অনুষ্ঠান আছে। সাড়ে সাতটায় একটা আলোচনাচক্র আছে। আধুনিক বাংলা ভাষাকে কীভাবে বাঁচিয়ে রাখা যায় তাই নিয়ে। ঘোষণার ফাঁকে ফাঁকে হালকা সুরে গান হয়ে চলেছে। গানের ফাঁকে ফাঁকে ঘোষণা- বই পড়ুন,বই পড়ান.. এইসব দুহাতে সরাতে সরাতে আমি এগোতে থাকি। আমার হাতে প্যাকেটে মোড়া গুলজার আর একগাদা কুচো কাগজ। লিফলেট। ঢোকার সময় হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল। বাথরুম পাচ্ছে। খিদে পাচ্ছে। ফুডকোর্টের দিকটায় বেজায় ভিড়।
অসাধারণ লিখেছিস ভাই, কোন লাইন টা নিয়ে কমেন্ট দিই বুঝতে পারছি না, পুরো একটা ছোট ছায়াছবির মত সব যেন চোখে ভেসে উঠলো. ধন্যবাদ তোকে এত সুন্দর একটা পারাগ্রাফ পড়ানোর জন্য. মনে রাখলাম এই ছোট জিনিস টা.
উত্তরমুছুনsatti tai, pradiptoda, amader kobi anek bodle gachhen.....
উত্তরমুছুন