০৫ আগস্ট ২০১১

ঘেংরু

হ্যাঁ, আজ আমি চৌধুরী লেনেরই বাসিন্দা বটে। যদিও আমার বাড়ী এই চৌধুরী লেনের চাপাকলটি সেই বিরাটির ডোবার চেয়ে অনেক ছোট, যদিও এর জল সেই ডোবার জলের মত সবুজ শ্যাওলামাখা নয়, কেমন যেন গেরুয়া রঙের মেটে-মেটে গন্ধ,যদিও এখানে আমি একলা,তবু কম দিন তো এখানেও কাটল না!
আমি কিন্ত জন্মেছিলাম বিরাটির সেই বিখ্যাত ডোবায়। তার অবশ্য কোনও নাম নেই,ডোবাদের আবার কবেই বা নাম থাকে! কিন্ত নাম না থাকলেও চিনতে তাকে বিশেষ কিছু অসুবিধে হবার নয়।সেই যে ডোবাটার এক কোণে শিউলীগাছ, এক কোণে আমড়াগাছ, আর এক কোণে কাঁঠালগাছ।কাঁঠালগাছে আবার কী একটা লতা বেয়ে উঠেছে। সেই ডোবার জল  ভোরে থাকে লালচে-সবুজ, দুপুরে ঝিকমিকে রূপোলী-সবুজ,সন্ধেয় ফিকে থেকে ঘন গাঢ় সবুজ, আর রাতে কালোর উপর সোনালী ফুটকি। সে ডোবাতে মশারা ডিম পাড়ে লাখে লাখে, জলফড়িং আর কত পোকামাকড়!
খাবারে ভাঁড়ারে ভর্তি। তার পাড়ে আমড়াগাছে আমড়া পাকে; শালিক,হলুদমণি,টিয়া,বউ-কথা-কও আমড়া খেতে ভিড় জমায়। সেই অপরূপ সুন্দর ডোবায় আমি জন্মেছিলাম।
আস্তে আস্তে কালো পোকার মত কিলকিলে দেহ থেকে ল্যাজট্যাজ খসিয়ে বেড়ে উঠলাম সুন্দর পুরন্ত মিষ্টি একটি ব্যাঙের খোকা হয়ে। অনেক ভাই বোন ছিল আমার । কিন্ত মা সবচেয়ে বেশী আমাকেই ভালোবাসতো। কী করে বুঝলাম? এ তো খুবই সোজা! মা কি আর কাউকে ঘেংরু বলে ডাকত? মা’ই তো বলেছে,আমি না কি ভারী মিষ্টি,যেমন সুন্দর সুপুরুষ চেহারা,তেমনি গানের গলা। গ্যাঙর গ্যাং গান তো সব ভাই বোনই গাইত,কিন্ত কার এমন সাধা গলা
কত দিন যে মাকে দেখিনি! মা তো এই চৌধুরী লেনের ঠিকানা জানে না! আসবে কেমন করে? মা’র কথা মনে করলেই আমার চোখে জল আসে। ও হ্যাঁ - কী করে এখানে এলাম বিরাটি থেকে? - শোন তবে। সেই যে আশ্বিন মাস না- যখন বিরাটির ডোবা হল টইটম্বুর,ছোট ছোট পুঁটি মাছ লাফাচ্ছে, আমড়ার ডালে হিংসুক মাছরাঙা বসে? তখন একদিন লাফ দিয়ে উঠলাম ডাঙায়। ভাবলাম একটু পাড়া বেড়িয়ে আসি। মাকে গল্প করা যাবে’খন। দুই-তিন লাফেই পড়লাম এক ছিটে বেড়া দেওয়া ঘরের মধ্যে। তারপর আর পথ খুঁজে পেলাম না। একটা মস্ত চৌকির তলায় কি সব ছিল। একটা গোলমতো কি যেন ছিল,এক লাফে পড়লাম তার মধ্যে। আমড়াগাছে যেসব আমড়া ঝোলে,তারই মতো দেখতে কতকগুলি জিনিস ছিল। তার মধ্যে ঢুকে গেলাম।
রাত হয়ে এল। চৌকির তলায় অন্ধকার তো আগেই এল। তখনও বাইরে শালিকের ঝগড়া শোনা যাচ্ছে। শেষ অবধি ঝগড়াটগড়া সব মুলতুবি রেখে শালিকেরা ফিরে গেল যে যার বাসায়। ঝিঁঝিঁপোকারা ডাকতে লাগলো। আমি ঘাবড়ে গিয়ে চুপটি করে বসে রইলাম সেই গোল জিনিসটাতে।মা খোকাকে ঘুম পাড়িয়ে চৌকিতে শুইয়ে দিয়ে গেল। মা’র কথা মনে করে আমার কান্না পেল।
কখন ঘুমিয়ে পড়েছি হুঁশ নেই।  হঠাৎ কে যেন আমার বিছানা ধরে টানে। একটা শাঁখাপরা হাত ঝপ্ করে একটা ঢাকনি ফেলে দিল আমার মাথায়,আমি থতমত খেয়ে গেলাম। কে যেন মিষ্টি গলায় বলে উঠল "ভোতন,দিদিমার জন্য আমড়া দিলাম এই ঝাঁপিতে,যাবার সময় ভুলিস না”। বুঝলাম ভোতন দিদিমার কাছে যাবে,আমি ঝাঁপিতে আছি,আমিও যাবো। আচ্ছা ‘ভোতন’ নামটা কি ‘ঘেংরু’র চেয়েও বেশী মিষ্টি? মনে মনে উচ্চারণ করলাম’ঘেংরু  ঘেংরু!’ - ঠিক বুঝতে পারলাম না।
তারপর সকাল হল। ভোতন আর তার বাবা ফ্যান-ভাত,আলুসেদ্ধ,ঝিঙেসেদ্ধ কাঁচালংকা মেখে খেল। আমি শুনে শুনে এতসব বুঝতে পারলাম। খেয়ে দেয়ে ঝাঁপিটা আর আরও কীসব বাক্স টাক্স নিয়ে ভোতন আর তার বাবা চলল।আমি ঝাঁপিতে বসে দুলতে দুলতে ঘুমিয়ে পড়েছি,জেগে উঠে শুনি লোকজন কথা বলছে। ভোতন নাকি বাসে উঠেছে। একটা লোক সক্কলের ভাড়ার জন্যে পয়সা নিল।শুধু ঝাঁপির মধ্যে যে আছে তার জন্য পয়সা নিল না। আবার ঘুমিয়ে পড়েছি,ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছি বিরাটির ডোবার। “শ্যামবাজার! শ্যামবাজার!” - কারা যেন চ্যাঁচাতে লাগল,আর ঝাঁপি সামলে ভোতনবাবু বাবার সঙ্গে নামল। এরপর ভোতনের মামাবাড়ি! খানিক চ্যাঁচামেচি আর উল্লাসের পর যেই মামী ঝাঁপি খুলেছে,অমনি আমি দিলাম পেল্লায় এক লাফ। মামী,‌মামা,বুড়ী দিদিমা,তিন চারটে পুঁচকে বাচ্চা,ভোতন আর তার বাবা - সব্বাই মিলে কী চ্যাঁচানই না চ্যাঁচাল! আমি কিন্ত ততক্ষণে রাস্তায় পড়েছি থপাস করে। উঃ! কি শক্ত রাস্তা! না আছে ঘাস,না আছে পাতা,না আছে নরম মাটি।ব্যথা লাগল বেশ। চারপাশ তাকিয়ে আমার একটুও ভালো লাগল না।কেমন যেন সব শক্ত বিচ্ছিরি। না আছে গাছ,না আছে ফুল,না আছে কাদা,না আছে জল।ছিঃ! ছিঃ! এই ভোতনের মামাবাড়ীর দেশ! উপরে তাকিয়ে দেখি আকাশ যেন ডোবায় মাজা কাঁসার থালার মতো ঝকঝকে।আলো ঠিকরে পড়ছে। ভোতনের বয়সী ছেলেরা আমাকে দেখে ঢিল ছুঁড়তে লাগল - ‘ব্যাং! ব্যাং! কোত্থেকে এল?’ আমি গলা ফুলিয়ে বললাম - ‘এসেছি বিরাটির ডোবা থেকে। ব্যাং ব্যাং করছ কেন, আমার কি নাম নেই? আমার নাম ঘেংরু।’ শুনে ছেলেরা আমাকে ভেংচে তেড়ে এল,আমি একটা ভাঙা নালার মধ্যে ঢুকে প্রাণ বাঁচালাম। সেই নালায় কতকগুলো লম্বা-শুঁড় আরশোলা ছিল। তাদের মত ভদ্রলোক আমি জীবনে দেখিনি। তারাই আমাকে বলল,এ হচ্ছে কলকাতা শহরের বিখ্যাত রাস্তা চৌধুরী লেন। এ শহরের হালচাল অন্য। ঠিকমতো হাঁটতে চলতে না জানলে পিষে যেতে হবে।আমি যখন ডোবার কথা তাদের বললাম,শুনে তারা তো অবাক! তারা নর্দমার জলই ভালোবেসে বারো মাস খায়। আমার তো তা চলবে না। মা শুনলে বলবে কী? তারপর একটা বুড়ো আরশোলা খবর দিল এই চাপাকলের। রাস্তার লোকজন কমে এলে সেই বুড়োর সঙ্গেই রাস্তার পাশের চাপাকলে গেলাম।সেখানের জল নাকি গঙ্গানদীর জল,নল বেয়ে এসেছে,খুবই নাকি পবিত্র। বুড়ো আরশোলা বললে ‘চাপা কলেই থাকো,জল পাবে,তীর্থবাস হবে,পুণ্যি হবে তোমার'। এই সেই চাপাকল। তার এক পাশে একটি ফাটল,যার মধ্যে আমি নিশ্চিন্তে ঢুকে বসতে শুতে পারি।পোকামাকড়ের অভাব কলকাতা শহরে নেই। মাঝে মাঝে আরশোলা পরিবারও ভালো-মন্দ কিছু পেলে ভাগ দেয়।ছেলে-পুলে’দের থেকে সামলে থাকতে হয়। একটা তো একদিন চাপাকলে হাতই ডুবিয়েছে আমাকে ধরার জন্যে। খুব বেঁচে গিয়েছি সেদিন।

আজ এই চৌধুরী লেনেও মেঘ জমেছে আকাশে। কাঁসার থালার রং কাঁঠালগাছের ছায়ার মতো কালো হয়েছে। চাপাকলের জলের উপর মুখ আর চোখ ভাসিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি আমি। বৃষ্টি পড়ছে। আমার চোখের সামনে এই কালো ভিজে আকাশের নীচে চৌধুরী লেনের গলি আর বিরাটির ডোবার ধার যেন একাকার হয়ে গেছে। সামনের রাস্তার আলোর খুঁটিটা যেন মনে হচ্ছে বিরাটির সেই আমড়াগাছ।তাতে বসে যে ভিজে কাকটা পালক খুঁটছে তাকে যেন আমি বিরাটি’তে দেখেছি। ঝরঝর করে প্রাণমাতানো ফোঁটাগুলো পড়ছে মুখে,চোখে,জলে,ফুটপাথে,ঘরবাড়িতে। বিরাটিতেও নিশ্চয়ই এখন বৃষ্টি হচ্ছে। ঠিক এইরকম স্নেহঝরানো বৃষ্টি। এই রকম সোঁদা গন্ধঅলা। এইরকম মন-কেমন করা। আমি চৌধুরী লেনের ঘেংরুবাবু (শহরের ভদ্রলোকদের ‘বাবু' বলে!) চুপ করে বসে বৃষ্টি দেখছি।আমার মন-কেমন করছে। গান গাইব কি গাইব না বুঝতে পারছি না। গলার মধ্যে সব গান যেন চাপা কান্নার মতো জমাট বেঁধে আছে। আমার কষ্ট হচ্ছে কি আনন্দ হচ্ছে - ঠিক বুঝতে পারছি না।
কেমন যেন মনে হচ্ছে,বিরাটির সেই আশ্চর্য ,সুন্দর শ্যাওলা সবুজ ডোবায় মা’র ঠিক পাশটিতে পৌঁছে গেছি। মা যেন গলা ফুলিয়ে আদর করে আমায় ডাকছে,’ঘেংরু!’


1 টি মন্তব্য:

  1. Golpo ta porechhi onek din agayi ... tor bolar thik next din.. kintu comment ta ajkei korchi. bolte gele maa pore shonalo. :) ar tui ebar feshechhis! coz tor readers er shonge shonge demand o bere gechhe :P ... tai ma bollo aaro erom golpo likhte karon net ghete eto bhalo golpo ar pelam na... tai shob ta tor ghade porlo!... golpo ta shotti byapok. kono kotha nei :) kudos buddy.....

    Just ekta jinish.. tor oi chhora gulo arektu boro kore ektu bhalo bhabe explain korish plz.. incomplete moto laglo, but u are free on that :) hungry for more... :D

    উত্তরমুছুন