বাজি একটা আশ্চর্য কর্ম। অথর্ব বেদ-এ নাকি 'বাজীকরণ' নামে একটা চ্যাপ্টার আছে, যেখানে যৌবনকে 'যেতে নাহি দিব'-র সুপ্ত ক্রিয়া কারসাজি নিয়ে আলোচনা আছে। যারা বিশেষ কোনো কর্মে পটু, সেই কর্মবাচক বিশেষ্যর সঙ্গে 'বাজ' যুক্ত করে তার সংশ্লিষ্ট বিষয়ের পটুত্ব বোঝানো হয়। যথা-গুলবাজ, রকবাজ, আলুবাজ, বক্তৃতাবাজ ইত্যাদি। আজকের সাদা কাক একজন বাজিবাজ। তার কর্মকান্ড শুরু হয়ে গেছে বেশ কিছু দিন আগে থেকেই। দোকান থেকে মাটি নিয়ে এসেছেন দু-তিন কিলো, ধোঁকা, করলাপটাশ ইত্যাদি নিয়ে এসেছেন। ওই বাজিবাজের আসল নামটা পালটে বরং অন্য একটা নাম দিচ্ছি - আনন্দময়। ওঁর কাছেই অবশ্য এই সব সাংকেতিক নামগুলো শেখা। যেমন, গন্ধক-কে বলতে হয় মাটি। গন্ধক বিস্ফোরক তৈরিতে ব্যবহার হয় বলে সম্ভবত বিক্রয় ব্যাপারে নিয়ন্ত্রণ আছে। পটাশিয়াম ক্লোরেট -কে বলা
হয় করলাপটাশ। কলেরাপটাশ নামেও বিখ্যাত। আনন্দময়বাবু বাজির মশলার দোকানে গিয়ে পোড়া কাঠ হাতে নিয়ে বলেন -এটা 'কুল' বলছেন? বললেই হলো? আম। ওঁর ওস্তাদ-চোখ কাঠের পোড়া শরীরেরও ডিএনএ টেস্ট করতে পারে, কাঠের কুল-গোত্র বুঝতে পারে। বাজি বানাতে গেলে কুল কাঠের কয়লা
নাকি ভাল। তবে সবচেয়ে ভালো নাকি বেগুন কাঠ।
তুবড়ি যদি ইলেকট্রিক করতে হয়, তবে অ্যালুমিনিয়াম চুর দিতে হয়। ভাল জাতের অ্যালুমিনিয়াম চুর পেতে গেলে দোকানে 'ধোঁকা' বলতে হয়। দোকানদার ওর সহকারীকে বলবে - আলুধোঁকা বার
কর তো....। আলুধোঁকা হলো ধোঁকাকৃতি অ্যালুমিনিয়ামের ভঙ্গুর খন্ড। হামানদিস্তায় ভালো করে গুঁড়ো করে নিতে হয়।
আমাকে আনন্দময়বাবুই এই সব ধোঁকাজ্ঞান দিয়েছেন। উনি তুবড়ির সঙ্গে রংমশালও সৃষ্টি
করেন। রংমশালে একটা সবুজ আভা বের হয়। উনি পিসি-র গুঁড়ো মেশান। পিসি হলো পি ভি সি-র গুঁড়ো।পাড়ার
রঙের দোকানে 'গোপাল বার্নিশ' চাইলে আপনাকে যে বার্নিশটা দেবে, তা হলো কেপল বার্নিশ.
কেপল যে-ভাবে গোপাল হয়ে যায়, সে ভাবেই পি ভি সি পিসি হয়ে যায়। পি ভি সি হলো এক ধরনের
প্লাস্টিক। একটু লাল বিচ্ছুরণের জন্য চাই স্টোনের গুঁড়ো। স্টোন মানে স্ট্রনসিয়াম অক্সাইড। আমাদের আনন্দময়বাবু এ সব মশলা কিনে এনে কয়েক দিন রোদ্দুর খাওয়ান, তার পর হামানদিস্তায়
গুঁড়ো করেন, তার পর আবার রোদ্দুর।
আনন্দময়কে দেখতাম মাঝেমধ্যে ফোনে করতে। ফোনে কারোর
সঙ্গে কিছু সংখ্যা বলাবলি করতেন। যেমন - ২-১০-১-৬ নাকি ৩-৯-২-৮? উনি শেয়ার বা ফাটকার
পথ মাড়ান না। এগুলো হলো তুবড়ির ফর্মুলা। কাঠ কয়লা-সোরা-গন্ধক-লোহাচুরের ভাগ। কিছু তুবড়ি
উনি ইলেকট্রিক করবেন, কিছু রংমশালে স্টোন দেবেন। তার পর বাহারি খোলে ভরবেন, রঙিন কাগজে
মুড়বেন, তার পর?
তার পর আনন্দময়বাবু ডায়রিটা বের করবেন। ওখানে অনেক ঠিকানা লেখা। প্রতি বছর
নতুন ঠিকানা যোগ হয়। ব্যাগে রংমশাল আর তুবড়িগুলো পুরে লোকের বাড়ি বাড়ি যাবেন, অনাথ আশ্রমে
যাবেন। পুলের তলায় ভিখিরিদের কাছেও।
বিক্রি করতে নয়, বিলি করতে। ওঁর বন্ধু রতনের দুই ছেলে। ওদের জন্য চারটে তুবড়ি, আটটা রংমশাল। বিশুর তো একটাই মেয়ে, ওর জন্য কিছু কম। এ রকম সুধীর, অলোক, সমীরণ ইত্যাদিরা আছে.
এঁদের ছেলেমেয়েরা ক্রমশ বড় হয়ে যায়, রংমশাল জ্বালায় না আর। আনন্দময় বলেন-তোমাদের ভাগ্নে-ভাগ্নি
নেই? ভাইপো-ভাইঝি?
কার বাড়িতে নতুন বাচ্চা হল সেই সংবাদ রাখেন হিজড়েরা আর আনন্দময়বাবু। শিশুর বয়স পাঁচ হলে হাতেখড়ি, ছয় হলে হাতে রংমশাল। পাড়ার মুদি দোকানিটি বিয়ে করেছে। আনন্দময়ের পুলক জাগে। আমায় বলেন, আপনার পুত্রটি তো বিয়ের যুগ্যি হলো, বিয়েটিয়ে করবে কবে? বলি-
বিয়ে করবে, ওর সন্তান রংমশাল ধারণ-যুগ্যি হবে, ততদিন আপনি রংমশাল বানাবার যুগ্যি থাকবেন
তো? আনন্দময় হাসেন. বলেন, থাকতেই হবে। যেন থাকি। বাজীকরণ তো করছি।
আনন্দর নিজের সন্তান নেই, নিজের নাতিপুতিদের হাতে আলোর নাচন দেখার সম্ভাবনা
নেই। কিন্তু বাচ্চাদের মুখে একটু হাসির ছটা দেখবার জন্যই ওঁর এই এক মাসের বাজীকরণ প্রক্রিয়া। উনি বলেন, সবার হাতের আলো হয়তো দেখতে পাই না, কিন্তু আলো নাচে - আমার প্রাণের কাছে।আলোর ঢেউয়ে মল্লিকা, মালতীরা, মন্টু-সন্টুরা মেতে ওঠে, মাইরি, কী ভাল লাগে!
এই প্রতিবেদনটা
লেখার দু'দিন আগে ওঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। দেখলাম,বিমর্ষ। বললেন, বাড়ির কাজের মেয়েটা লাইগেশন করিয়ে এসেছে। ওর দুটো মোটে বাচ্চা। খুব মন খারাপ। সবাই যদি আমার সঙ্গে এ ভাবে বিট্রে করে,
আমি কী নিয়ে বাঁচব?স্বপ্নময় চক্রবর্তী
২০শে অক্টোবর ২০১৩ 'রবিবাসরীয়' আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন