০৭ জুন ২০২২

কৈখালি ২০২০

 কৈখালিতে উইক এন্ড - 


প্রকৃত প্রস্তাবে অফবিট জায়গা। পার্কিং প্লেস গড়ে ওঠার দরকার পড়ে নি এখনো। জয়নগর থেকে ত্রিশ কিলোমিটার রাস্তা, অবস্থা সাপেক্ষে ঘন্টা খানেক লাগবে যেতে। নদীবাঁধ অবধি গিয়ে শেষ হয়েছে রাস্তা। শ্রীরামকৃষ্ণ আশ্রমের ক্যাম্পাসটি সুন্দর। নদীবাঁধের গায়েই কৈখালি পর্যটক আবাস। মাতলা এখানে ক্যানিং এ দেখা শীর্ণা বালিকা নয়, দু'কুল দেখা যায় না তেমন পূর্ণ এক নদী। মজবুত নদীবাঁধটি দিয়ে শান্ত রাখা হয়েছে সমুদ্রমুখী নদীটিকে। এ পাড়ার গাছেরা একটু অন্যরকম। বাঁধের গায়ে মাটি থেকে উঠে থাকা তাদের শ্বাসমূলগুলো আপনাকে নির্ভূল চিনিয়ে দেবে আপনি সুন্দরবনের কাছাকাছি কোথাও আছেন। আদিগন্ত জল আর আকাশ, আর দূরের দ্বীপরেখা, মাছ ধরার নৌকো, দূর দিয়ে চলে যাওয়া ট্রলার - মিলেমিশে এক ক্যানভাস ছবি। কাদামাটিতে নোঙর করে রাখা লঞ্চ। সারাই হয়ে জলে ফিরে যাওয়ার অপেক্ষায় নৌকো। একটা ছোট্ট বাজার এলাকা। ভাতের হোটেল। বিকেলবেলা বাঁধের ওপরের রাস্তাটা বরাবর নদীর দিকে হাঁটলে চা-সিগারেট থেকে ফুচকা-আলুকাবলি-ঝালমুড়ি-আইসক্রিম।

মীন ধরার মরশুমে 'লাইভ' মাছ ধরা দেখা যায়। মাছ ভর্তি নৌকো সাঁতরে এসে পৌঁছয় ঘাটে। আমার গিন্নী এবং আরও কয়েকজন মৎস্য প্রেমিক বেড়ালের মত এগিয়ে যান। ঝুড়িতে কী কী মাছ উঠল। 


আগেও এসেছিলাম ডে ট্রিপে বার দুয়েক। বাইক রাইড করে। গাড়ি ড্রাইভ করে। এবারে ঠিক করেছিলাম এক রাত থাকব। শান্ত নির্জন কৈখালি'তে কোন হোটেল বা হোমস্টে নেই। রাত্রে থাকার একমাত্র জায়গা হল কৈখালি পর্যটক আবাস। ফোনে বুকিং হয় নিমপীঠ শ্রীরামকৃষ্ণ আশ্রম থেকে। ট্রেনে সাউথ শিয়ালদা থেকে এসে নামলাম জয়নগর -মজিলপুর। স্টেশনের বাইরে নিমপীঠ আশ্রমে যাওয়ার অটো পাওয়া গেল। দশ মিনিট পথের অটোভাড়া দশ টাকা মাথাপিছু । সকাল সকাল পৌঁছে গেছিলাম। আশ্রম কর্তৃপক্ষের সৌজন্য অনবদ্য । একটা গেস্ট রুম খুলে দিলেন ঘন্টা দুয়েকের জন্য। সেখানে স্নানটান সেরে ফ্রেশ হয়ে নেওয়া গেল। মহারাজ বললেন 'চারদিকটা ঘুরে দেখুন, দুপুরে ভোগ খেয়ে, যাবেন কৈখালি'। 

বেলা বারোটার মধ্যে আশ্রমে পৌঁছে দুপুরের ভোগের জন্য টিকিট কাটা যায়। শেষপাতে পায়েস সমেত পুরোদস্তুর লাঞ্চ'টির জন্য টিকিট মাথাপিছু দশ টাকা ন্যূনতম। নিমপীঠের শ্রীরামকৃষ্ণ আশ্রমটির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সন্ন্যাসী স্বামী বুদ্ধানন্দজী মহারাজ। রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন ভাবধারা অনুসারী, কিন্ত মিশনের অংশ নয়, এই সংস্থাটি, সুন্দরবনের এই অঞ্চলটির মানুষদের হাতে কলমে স্বনির্ভর হয়ে ওঠার পাঠ দিয়ে যাচ্ছে গত পঞ্চাশ বছর যাবৎ । ঘুরে দেখলাম প্রাথমিক বিদ্যালয়, মেয়েদের স্কুল, হাসপাতাল, আশ্রমের নিজস্ব ফুল-ফল-সবজির খেত খামার, ল্যাবরেটরি। শ্রীরামকৃষ্ণ -সারদা- স্বামী বিবেকানন্দের সুসজ্জিত মন্দির চত্বরটি বেলুড় মঠের পরিবেশটির কথা মনে করায়। 

দুপুরে পংক্তিভোজন সেরে রওনা দেওয়া গেল কৈখালি। আশ্রম কর্তৃপক্ষই 'রিজার্ভড অটো' ঠিক করে দিয়েছিলেন। সাড়ে তিনশো টাকা আর গ্রামের রাস্তায় এক ঘন্টায় - নিমপীঠ থেকে কৈখালি। 


কৈখালি তে তখন বিকেল ফুরিয়ে শীতের সন্ধে নামছিল। ধূ ধূ জলরাশির ওপর নীল হয়ে অন্ধকার নামতে নামতে গোটা একটা দিনের আলো ফুরিয়ে আসাটুকু ধরে রাখার মত ক্যামেরার লেন্স আজও আবিষ্কার হয়নি। কোনওদিন হবেও না। তা'ও যেটুকুই পাওয়া যায় তাই'ই ধরে রাখতে চাওয়ার লোভ বড় চিরন্তন। মোবাইল ক্যামেরাটা বের করলাম। 

সন্ধের পর কিছু করার নেই এখানে। কিছু করার নেই - কথাটা যুগপৎ আক্ষরিক এবং আপেক্ষিক। হয় আপনি চূড়ান্ত বোর হবেন আর নয়তো এরকম একটা সন্ধেবেলা কাটানোর জন্যেই আবার আসতে চাইবেন এখানে। পর্যটক আবাসের ঘরে টিভি নেই। মোবাইলে নেট ভালো পাওয়া যায় না। সন্ধের পর অতএব যাকে বলে - 'থাকে শুধু অন্ধকার মুখোমুখি বসিবার ..'। একা অথবা কয়েকজন - আড্ডা দেওয়ার, গান শোনার, বই পড়ার পক্ষে আইডিয়াল একটা সন্ধের নির্ভরযোগ্য ডেস্টিনেশন কৈখালি । পর্যটক আবাসের ঘরে এবং চৌহদ্দি'তে মদ্যপান নিষিদ্ধ।

শ্রীরামকৃষ্ণ আশ্রম পরিচালিত পর্যটক আবাসটিতে কিন্ত শুধুই নিরামিষ নয়, মাছ-মাংস-ডিম সবই পাওয়া যায়। তবে মেনুকার্ড এর কোন ব্যাপার নেই। দু'বেলা ঘরোয়া ভাত রুটি ডাল সব্জি মাছ / মাংস/ডিম। সঙ্গে ব্রেকফাস্ট এবং বিকেলের টিফিন। খাবার খুবই ভাল। থাকা এবং খাবার মিলিয়ে মাথাপিছু ছ'শো টাকা প্রতিদিন। ঘরগুলি পরিচ্ছন্ন এবং আধুনিক সুবিধাযুক্ত। 


বিকেলের সূর্যাস্তর মতনই পরদিন ভোরে আদিগন্ত নদীর বুক থেকে সূর্য উঠতে দেখা একটা অসাধারণ অভিজ্ঞতা। আকাশ আর জলের জমকালো রঙের খেলা জমে ওঠে শুধু সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের সময়ই। ঊষা আর গোধূলির দুই চিরকালীন ' লাইট শো ' দেখার জন্যেই আসা যায় কৈখালি পর্যটক আবাসে। ক্যামেরা সমেত। শীতের সকালে টাটকা খেজুর রস টেস্ট করে দেখাটা ইনসেনটিভ । 

মরশুমের রোববারগুলোর সকালে এসে সন্ধেয় ফিরে যাওয়া পিকনিক পার্টির ভীড়ে সরগরম থাকে কৈখালির এই নদীবাঁধ। বছরের অন্য সময়ে তেমন ভীড় নেই। চাইলে যাওয়া যায় বোট রাইডে। নৌকো বা লঞ্চে নদী পার হয়ে ঘুরে আসা যায় ঝড়খালি থেকে। ওখানে বন বিভাগের ব্যাঘ্র প্রকল্প'তে খাঁচার ওপারে রয়েল বেঙ্গল এবং কুমীর দেখে ক্যামেরার আশ মেটানো যেতে পারে। বারোটায় দুপুরের খাবার। একটায় চেক আউট। ফেরার জন্যে অটো ঠিক করে দিলেন পর্যটক আবাস কর্তৃপক্ষই। জয়নগর-মজিলপুর স্টেশন অবধি পৌঁছতে নেবে চারশো টাকা। শীতের সময় জয়নগর থেকে বহড়ু অবধি এ তল্লাটে পাওয়া যাবে বিখ্যাত 'জয়নগরের মোয়া'। ফিরতি লোকাল ট্রেনে এক ঘন্টার জার্নি রোববার বিকেলেই পৌঁছে দিল শহরে।

ফেব্রুয়ারী ২০২০



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন