১২ জুলাই ২০১৬

মেঘ কুয়াশার দেশে

নভেম্বরের এক সকালে পৌঁছে গেলাম কালিম্পং। হাতে দিন পাঁচেকের ছুটি নিয়ে।  একটা দিন কালিম্পংয়ে ডেলো পাহাড় আর দুরপিন পাহাড় ঘুরে পরের দিনটা কোন দিকে যাব কিছু ঠিক ছিল না। চেনা দার্জিলিং চলে যাব না লাভা-লোলেগাঁও। পাহাড়ে বেড়াতে এসে সানরাইজ দেখতে যাবো না তাও কি হয়। আমাদের ড্রাইভার ছেলেটি পরামর্শ দিল সানরাইজ দেখতে হলে লোলেগাঁও যাওয়াই ভাল। বলল ওখানে একদিন থেকে তারপর লাভা চলে যেও। লোলেগাঁও থেকে এক ঘন্টাতেই পৌঁছে যাওয়া যায় লাভাআর লাভা থেকে শিলিগুড়ি ফেরার গাড়ি পেতেও সুবিধে হবে তোমাদের। পরের দিন সকালে রওনা দিলাম লোলেগাঁওয়ের দিকে। পঞ্চান্ন কিলোমিটার পাথুরে রাস্তাটা দিয়ে ঝাঁকুনি খেতে খেতে যাওয়া একটা অভিজ্ঞতা। একপাশে সোজা উঠে যাওয়া পাহাড়ের গায়ের নাম না জানা ফুল গাছপালা আর লতাপাতা অচেনা ঝোরা দেখতে দেখতে পাকদন্ডী বেয়ে নামতে নামতে এসে পৌঁছলাম রেলি নদীর শরীরে রিভার বেডে বছরের এই সময়টায় এখন জল নেই তেমনএকটা ঝরণার মত জলধারা সাদা পাথরগুলো ভিজিয়ে খেলতে খেলতে ছুটছে তিস্তার সঙ্গে গিয়ে মিশবে বলে। রিভার বেড পার হয়ে এবার অন্য একটা পাহাড়ে ঘুরে ঘুরে ওঠার পালাএকটু ওপরেই মেঘ জমে আছে । হাত বাড়িয়ে ছোঁয়ার কোনো দরকার নেই। একটু বাদেই আমরা পৌঁছে যাব ওদের ভেতরে। চুলের কাঁটার মত বাঁক অজস্র। মোবাইলের গুগল ম্যাপে রাস্তাটা সাপলুডোর বোর্ডের মত দেখাচ্ছে।ম্যাপ দেখে আশপাশের জায়গাগুলোর নাম জানার চেষ্টা করি। সবুজ পাহাড়ের গায়ে গুঁজে দেওয়া যেন ছোট্ট ঘরবাড়ীগুলো অনেক দূর থেকে দেখা যায়। রাস্তার পাশ দিয়ে মাঝে মাঝে পার হয়ে যায় এক একটা ছোট্ট গ্রাম। যত ছোট বাড়ীই হোক না কেন এক টুকরো ফুলের বাগান এদের সবার বাড়ীর সামনে।
পাইনের বন শুরু হল। পাহাড়ের ঢালে ঘেঁষাঘেঁষি করে সোজা দাঁড়িয়ে আছে  পাইন গাছের দলরোদ এসে পড়ছে পাহাড়ের ঢালে। গাছেদের ফাঁকে ফাঁকে দেখা যাচ্ছে দূরের পাহাড়ী গ্রামের ল্যান্ডস্কেপ। দূরে আকাশের নীচে ঘুমিয়ে আছেন বুদ্ধ। বরফে শরীর ঢাকা কাঞ্চনজঙ্ঘা। নানান শেডের নীল আর সবুজ রঙের খেলা দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম প্রায় সাড়ে ছ’হাজার ফুট ওপরে পাইন গাছের বনে আর মেঘ দিয়ে ঘেরা  নির্জন ছোট্ট গ্রাম  লোলেগাঁও। স্থানীয় নাম কাফের। কলকাতায় যাদের দেখতে গেলে মাথা উঁচু করে আকাশে তাকাতে হয় এখানে ওরাই ছুঁয়ে যাচ্ছে আমাদের। আজ মেঘলা দিন। ভিজে তুলোর মত মেঘ উঠে আসছে দক্ষিণ দিকের উপত্যকা থেকে। ঠান্ডা কনকনে হাওয়া। এমন হাওয়ায় অলস হাঁটতে ভালো লাগবে। হোটেলের ঘরে ব্যাগপত্তর রেখে বেরিয়ে পড়লাম। সাতটা কি আটটা বাড়ী। সবই প্রায় হোটেল। লাগোয়া ছোটো একটা দোকান। ক্যামেরার ব্যাটারি থেকে চটপটা মুখরোচক আচার, যার নাম তিতৌড়া,  ট্যুরিস্টদের জন্য ‘হঠাত করে ফুরিয়ে গেছে’ – মোটামুটি এমন সব কিছুই এখানে পাওয়া যাবে। পাশেই লোলেগাঁও মোটর স্ট্যান্ড। এখান থেকে গাড়ী পাওয়া যায় কালিম্পং, রিশপ, লাভা যাওয়ার জন্যে। সাইটসিয়িং করতে চাইলে গাড়ী পাওয়া যাবে এখানে থেকেই।

সন্ধে নেমে এলে মেঘ পাতলা হয়ে পাইন বনের ফাঁক দিয়ে চাঁদ বেরল। মায়াবী নরম আলোয়, দূরের পাহাড়ের গায়ে জোনাকির মত আলো জ্বলা কালিম্পং শহর দেখতে দেখতে রাত নেমে এল। কাল ভোরবেলা সূর্য ওঠা দেখতে যাব। সানরাইজ পয়েন্ট এখানে থেকে তিন কিলোমিটার । রাত থাকতে উঠে কনকনে ঠান্ডার মধ্যে রওনা দিলাম। একটু একটু করে আকাশের রঙ পালটানো শুরু হল। দূরে টাইগার হিলের মিটিমিটি আলো, উল্টোদিকের পাহাড়ে কালিম্পং শহরে আর ভুটান পাহাড়ের মাথায় তখনও ঘুম না না ভাঙা নীলচে মেঘের দলের মধ্যে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে করতে কমলা রঙের ছটা আমাদের মাথার ওপর দিয়ে আকাশ পার করে গিয়ে পড়ল কাঞ্চনজঙ্ঘার সাদা মুকুটে। ডিমের কুসুমের মত সূর্য উঠে পড়ল জলপাইগুড়ির দিগন্তেতার  শুরু হয়ে গেল ঝকঝকে একটা দিন।

মোটর স্ট্যান্ড থেকে পায়ে হাঁটা দুরত্বেই ক্যানোপি ওয়াক। পাইন আর ফার্নের জঙ্গলে গাছের মধ্যে দিয়ে কাঠের পাটাতন আর মোটা তার দিয়ে বানানো ঝুলন্ত ব্রিজ। একসঙ্গে পাঁচজনের বেশী ওঠা নিষেধ। ব্রিজ পেরিয়ে পায়ে চলা পথ ধরে কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে যাওয়া যেতে পারে মেঘ ছুঁয়ে থাকা সবুজ অরণ্যেফিরে আসার সময় মোটর স্ট্যান্ডের দোকানটায় বসে ঠান্ডা হাওয়া আর মেঘ মিশিয়ে এককাপ গরম কফির সঙ্গে কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকে তাকিয়ে কাটিয়ে দেওয়া যায় একটা গোটা ছুটির দিন। 










কীভাবে যাবেন ঃ

কলকাতা থেকে কালিম্পং কীভাবে  পৌঁছতে হয় সেটা এখানে বিশদে না লিখলেও চলবে। আমার মতে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে নেমে একটা অটো ধরে পৌঁছে যান পানিট্যাঙ্কি মোড়ে। অটো ভাড়া গত বছর নভেম্বর মাস অবধিও ছিল কুড়ি টাকা মাথাপিছু। পানিট্যাঙ্কি মোড় থেকে পেয়ে যাবেন কালিম্পং যাবার শেয়ারের গাড়ি। টাটা সুমো বা মাহিন্দ্রা বোলেরো জাতের গাড়ি আপনাকে ঘন্টা তিনেকের মধ্যে কালিম্পং পৌঁছে দিতে নেবে সাড়ে তিনশো - চারশো টাকা

কালিম্পং ট্যাক্সি স্ট্যান্ড থেকে লোলেগাঁও যাবার গাড়ি আপনাকে রিজার্ভ করে নিতে হবে বারোশ থেকে পনেরশ টাকার মধ্যে।

ডেলো

কালিম্পং থেকে এক বেলায় ঘুরে আসতে পারেন ডেলো। পাহাড়ের ঊপরে বাংলো থেকে দেখতে পাবেন একশো আশি ডিগ্রি ভিউতে কাঞ্চনজঙ্ঘা রেঞ্জ সমেত এক আশ্চর্য ছবি। শেয়ার ট্যাক্সি পাবেন কালিম্পং ট্যাক্সি স্ট্যান্ড থেকেই। সাইটসিয়িং ট্যুরে ঘুরে আসতে পারেন দূরপিন দাড়া, থোংসা গোম্ফা, গলফ কোর্স, ক্যাকটাসের বাগান

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন